নিত্যকর্ম

নিত্যকর্ম (সংস্কৃত: नित्य कर्म) বলতে হিন্দুধর্ম অনুসারে সেই কর্ম বা আচারকে বোঝায় যা প্রতিদিন সম্পাদন করা প্রয়োজন।[১] নিত্যকর্ম সংস্কৃত শব্দ, এবং এটি দুটি শব্দ নিয়ে গঠিত- নিত্য (সর্বদা) ও কর্ম (আচরণ বা কর্তব্য)। [২]



বেদ পাঠশালার ছাত্ররা তামিলনাড়ুরনাচিয়ার কোভিল, কুম্বকনম -এ সন্ধ্যাবন্দনা করছে।

হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে, নিত্যকর্ম সম্পাদনে অবহেলা করলে পাপ হবে।।[২] নিত্যকর্মের অর্থ শুধু দৈনন্দিন কর্তব্য নয়, এতে নিয়মিত বা পর্যায়ক্রমিক নির্ধারিত কার্যক্রম বা দায়িত্ব অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।[২] নিত্যকর্মের উপবিভাগ আছে যাকে নৈ-নিত্যকর্ম বলে।[২] এর অর্থ বাধ্যতামূলক কর্ম কিন্তু শর্তাধীন।


নিত্যকর্ম সমূহ সম্পাদনা


একটি হিন্দু মন্দিরে "পঞ্চামৃত" সহ অভিষেকের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হচ্ছে।


হিন্দুধর্মে নিত্যকর্মের তালিকা ও পদ্ধতি সম্প্রদায়ের উপর নির্ভরশীল। নিন্মে নিত্যকর্মের কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো:


স্নানযাত্রা- স্নান (অভিষেক) ; যে দেবতার উপাসনা করা হয় তাঁর স্নান করানো।[৩]


সন্ধ্যাবন্দনা- দিনের উদ্বোধনী ও বন্ধের সময়ে সম্পাদিত ধর্মীয় অনুষ্ঠান।[২] সন্ধ্যাবন্দনা একটি বাধ্যতামূলক ধর্মীয় অনুষ্ঠান যা ঐতিহ্যগতভাবে হিন্দুদের দ্বিজ সম্প্রদায় দ্বারা করা উচিত।[৪][৫]


উপাসনা - বৈবাহিক আগুন জ্বলন্ত রাখা।[২]উপাসনা হল একটি যজ্ঞ যা বিবাহীত দীক্ষিত হিন্দুদের দ্বারা প্রতিদিন সম্পাদিত হয়।[৬]


অগ্নিহোত্র- উত্তপ্ত দুধের নৈবেদ্য।[২] অগ্নিহোত্র কঠোর রীতি অনুসারে পবিত্র আগুনে ঘি ঢালার যজ্ঞকে বোঝায়, এবং শরৌত ঐতিহ্য অনুসারে তাদের দ্বারা প্রতিদিন দুবার উত্তপ্ত দুধের নৈবেদ্য অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।[৭]


প্রার্থনা- প্রার্থনা হিন্দুধর্মের অনুশীলনের কেন্দ্রীয় বিষয়। এগুলি আচার ও আধ্যাত্মিক উভয় অনুশীলনে ব্যবহৃত হয়। প্রার্থনা থেকে হিন্দু ধর্মের উৎপত্তি। ভক্তিমূলক পূজায় হিন্দুরা তাদের ভালবাসা ও ভক্তি প্রকাশের জন্য প্রার্থনা ব্যবহার করে। ঐতিহ্য উভয় প্রার্থনার নীরব এবং জোরে আবৃত্তি অনুমোদন করে। প্রার্থনা ধর্মীয় পূজায় (যজ্ঞ) পাশাপাশি গার্হস্থ্য পূজায় (পূজা) ব্যবহার করা হয়। [৮]


দেবতা অর্চন- পূজা ; গৃহে বা মন্দিরে নিত্যপূজা, উৎসব উপলক্ষে বিশেষ পূজা অথবা যাত্রা বা কার্যারম্ভের পূর্বে কৃত পূজা ইত্যাদি।[৯]


পঞ্চ নিত্যকর্মসম্পাদনা


পঞ্চ নিত্যকর্ম সংস্কৃত শব্দ যার অর্থ, "প্রত্যেক হিন্দুর পাঁচটি চিরস্থায়ী কর্তব্য।"[১০] এই মহৎ ধর্মীয় নীতি অনুসারে জীবন যাপন করে, আমরা আমাদের ধর্মীয় জীবনকে আধ্যাত্মিক করি এবং আমাদের নিজস্ব ঐশ্বরিক স্বরূপ উপলব্ধি করি।[১০] পঞ্চ নিত্যকর্মগুলো হলো:


উপাসনা: বাড়িতে বা মন্দিরে বেদীতে পূজা।[১০]


উৎসব: পবিত্র দিন।[১০]


ধর্ম: পুণ্যময় জীবন যাপন।[১০]


তীর্থযাত্রা: দর্শনের মাধ্যমে পবিত্র ব্যক্তিদের কাছ থেকে আশীর্বাদ ও অনুপ্রেরণা লাভের লক্ষ্যে শিশুদের পবিত্র স্থান ও মন্দিরগুলিতে তীর্থযাত্রা করার মূল্য প্রকাশ করা হয়।[১০]


সংস্কৃতি: আচার ও উত্তরণের অনুষ্ঠান।[১০]


অন্যান্যসম্পাদনা


যেকোন কাজ শুরুর সময়:


ওঁ তৎ সৎ। (তিন বার)


বাড়ি থেকে রওনার সময়:


ওঁ শ্রী বামনায় নমঃ।


ওঁ স্বমঙ্গলমঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিক।

শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়ণি নমোহস্ততে।।

অথবা, দুর্গা, দুর্গা, দুর্গা


শয়নের পূর্বে:


বিছানায় বসে:

ওঁ যজ্জাগ্রতো দূর মুদৈতি দৈবং তদুসুপ্তস্য,

তষ্মে মনঃ শিব সংকল্প মস্ত।।


ঘুমানোর সময়ে:

ওঁ শ্রী পদ্মনাভায় নমো নমঃ।

অথবা, ত্বয়ি রাত্রি বসামসি স্বপিষ্যামসি জাগৃহি।

গোভ্যোনঃ শর্ম য়চ্ছাশ্বেভ্যঃ পুরুষেভ্য।।

(অথর্ববেদ ১৯.৪৭.৯)


ঘুম থেকে জাগার পর:


বিছানায় বসে:

ব্রহ্ম মুরারি স্ত্রিপুরান্তকারী ভানুঃ শশী ভূমিসুতো বুধশ্চ শুক্র শনি রাহু কেতুস্তু কুর্বন্তু সর্বে মম সুপ্রভাতম।।

অর্থ: ব্রহ্ম, মুরারি (বিষ্ণু), স্ত্রিপুরান্তকারী (শিব), সূর্য, চন্দ্র, বুধ, গুরু, শুক্র, শনি, রাহু, কেতু- সকলে আমার প্রভাতটি সুন্দর করুন।


অতপর পূর্বমুখী হয়ে মাটি স্পর্শ করে:

ওঁ প্রিয়দত্তায়ৈ ভূম্যৈ নমঃ।


ঘর থেকে বের হয়ে: 

ওঁ জবা কুসুম সস্কাংশ কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং ধ্বান্তারিং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোহষ্মি দিবাকরম্।


খাদ্য গ্রহণের সময়:


শুরুতে:

ওঁ অন্নপতেহন্নস্য নো দেহ্যনমীবাস্য শুষ্মি নঃ।

প্র-প্রদাতারং তারিষ ঊর্জং নো দেহী দ্বিপদে চতুষ্পদে।। (যজুর্বেদ ১১। ৮৩)

অর্থ: হে অন্নদাতা প্রভু! তোমার করুণায় এই অন্ন আমাদের রোগনাশক ও পুষ্টিবর্ধক হোক। জগতে অন্ন দানকারীদের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি হোক। সকল দ্বিপদী ও চতুষ্পদী প্রাণী অন্নপ্রাপ্য হোক।

অথবা, ওঁ শ্রী জনার্দ্দনায় নমঃ।


শেষে:

ওঁ মোঘমন্নং বিন্দতে অপ্রচেতাঃ সত্যং ব্রবীমি বধ ইৎস তস্য।

নার্য়মণং পুষ্যতি নো সখায়ং কেবলাঘো ভবতি কেবলাদী।। (ঋগ্বেদ ১০।১১৭।৬)

অর্থ: মূঢ় ব্যক্তি অন্নকে ব্যর্থপ্রাপ্ত করছে, তারা অন্নের ঘাতক, কারণ যারা অন্নকে প্রাপ্ত করার পরে সমাজ ও রাষ্ট্রকে কিছু দেয় না তথা নিজ বন্ধুবর্গকে অন্ন প্রদান করে না, কেবল একাই উপভোগ করে বস্তুতঃ সে পাপযুক্ত উপভোগ করে। হে প্রভু! আমাদের পর্যাপ্ত অন্ন প্রদান করো যেন আমরা সবাই মিলে মিশে উপভোগ করতে পারি।।

অথবা, ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ


স্নানের ক্ষেত্রে:


স্নানের পূর্বে:

ওঁ গঙ্গে চ যমুনেচৈব গোদাবরি সরস্বতী।

নর্ন্মদে সিন্ধো কাবেরি জলেহস্মিন্ সন্নিধিং কুরু।।


স্নানের সময়: 

ওঁ কুরুক্ষেত্রং গয়া গঙ্গা প্রভাসপুষ্করাণি চ।

তীর্থান্যেতানি পুণ্যানি প্রাতঃস্নানকালে ভবন্ত্বিহ।।

অর্থ: প্রভু! পবিত্র কুরুক্ষেত্র, গয়া, গঙ্গা, প্রভাস ও পুস্কর তীর্থের পূণ্য সকল এ স্নানের সময় লাভ হোক।

অথবা

ওঁ শংনো দেবীরভিষ্টয় আপো ভবন্তু পীতয়ে।

শংয়োরভি স্রবন্তু নঃ।। (ঋগ্বেদ ১০.৯.৪)


সু-সংবাদ শুনলে:

ওঁ য একবর্ণ বহূধা শক্তি যোদাগ বর্ণান্ অনেকান নিহিতার্থে দধ্যাতি।

বিচৈতি চান্তে বিশ্বামাদৌ স দেবঃ স নো বুদ্ধ্যা শুভয়া সংযুনক্তু।।

অর্থ: যিনি নিরাকার, প্রয়োজনে বহুরূপ ধারণ করেন, আদিতে বিশ্ব যা হতে উদ্ভূত এবং অন্তে বিশ্ব যাতে লীন হয়ে যায় সেই পরম দেবতা আমাদের শুভবুদ্ধি প্রদান করুন।

অথবা, ওঁ শুভ মস্তু ।

ওঁ শুভ ভবতু।।


দুঃসংবাদ শুনলে:

ওঁ আপদং অপবাদশ্চ অপসরঃ।।


মৃত্যুসংবাদ শুনলে:


প্রেহি প্রেহি পথিভিঃ পূর্ব্যেভির্য়ত্রা নঃ পূর্বে পিতরঃ পরেয়ুঃ।

উভা রাজানা স্বধয়া মদন্তা য়মং পশ্যাসি বরুণং চ দেবং।।

(ঋগ্বেদ ১০.১৪.৭)

অর্থ: হে মৃত জীব! যে পথে আমাদের পূজ্য পিতৃপুরুষগণ গিয়েছেন, তুমিও সেই পথে গমন করো এবং গমন করে প্রসন্নভাবে মুক্ত জীবাত্মা ও ঈশ্বর উভয়কে দেখো।


সং গচ্ছস্ব পিতৃভিঃ সং য়মেনেষ্টাপূর্ত্তেন পরমে ব্যোমন্।

হিত্বায়াবদ্যং পুনরস্তমেহি সং গচ্ছস্ব তন্বা সুবর্চাঃ।

(ঋগ্বেদ ১০.১৪.৮)

অর্থ: হে মৃত জীব! তুমি মুক্ত হইয়া পরমলোকে (স্বর্গলোকে) পিতৃপুরুষ, বিদ্বান মুক্তাত্মা ও পরমাত্মার সহিত মিলিত হও। মুক্তিকাল সমাপ্ত হইলে পাপ পরিত্যাগ করিয়া পুনরায় এই সংসারে আগমন করো এবং নতূন শরীরের সংযোগ লাভ কর।


ওঁ তস্য আত্মানস্য সদ্গতি ভব।

অথবা, দিব্যান্ লোকান স্ গচ্ছতু।


জন্মসংবাদ শুনলে: 

ওঁ আয়ুষ্মান ভব ! (পুরুষের ক্ষেত্রে)(তিনবার)


ওঁ আয়ুষ্মতী ভবঃ (নারীর ক্ষেত্রে)


বিপদের সময়:

ওঁ মধুসুদনায় নমঃ ! (তিনবার)


গৃহে প্রবেশেকালে:

ওঁ বাস্তুপুরুষায় নমঃ।


শৌচাগারে প্রবেশেকালে:

ওঁ আজ্ঞা কুরু বসুন্ধরা।


অধ্যয়নের সময়:


ওঁ সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে বিশ্বরূপে বিশালাক্ষি বিদ্যাং দেহি নমোহস্তুতে।।


ওঁ মেধাং মে বরুনো দাদাতি মেধাগ্নিঃ প্রজাপতিঃ।

মেধামিন্দ্রশ্চ বায়ুশ্চ মোধাং দাতা দাদাতি মে স্বাহা।।


বিবাহসংবাদে:

ওঁ প্রজাপতায় নমঃ !


ঔষধ সেবনকালে:

ওঁ বিষ্ণু ! ওঁ বিষ্ণু ! ওঁ বিষ্ণু !


মৃত্যুকালে:

ওঁ তৎ সৎ ! (তিন বার)

অথবা, ওঁ নারায়ণ ! (তিন বার)


খারাপ স্বপ্ন দেখলে:

ওঁ গোবিন্দায় নমঃ !


প্রিয়া সঙ্গমের সময়:

ওঁ রাধায় নয়ঃ।


ভ্রমণের ক্ষেত্রে যাত্রার সময়:

পূর্বাপরং চরতো মায়য়ৈতৌ শিশুক্রীড়ান্তৌ পরিয়াতৌ অর্ণবম্।

বিশ্বান্যো ভুবনাবিচষ্ট ঋতুরণ্যো বিদধৎ জায়সে নবঃ।।

(অথর্ববেদ ৭.৮১.১)


বিশ্রাম নেয়ার সময়:

শান্তানি পূর্ব রূপাণি শান্তংনোস্তু কৃতাকৃতম্।

শান্তং ভূতং চ ভব্যঞ্চ সর্বমেব শমস্তুনঃ।।

(অথর্ববেদ ১৯.৯.২)


বাড়িথেকে পদব্রজে গমনকালে:

কৃষ্ণ কেশব, কৃষ্ণ কেশব, কৃষ্ণ কেশব ত্রাহি মাং।

রাম রাঘব, রাম রাঘ, রাম রাঘব রক্ষ মাং।।


যানবাহন আরোহনকালে:

ওঁ নারায়ণ ! (তিন বার)


কোন কারণে ভীত হলে:

রাম ! রাম ! রাম !

অথবা, ওঁ বিষ্ণু, ওঁ বিষ্ণু, ওঁ বিষ্ণু


কারো কুকর্ম সম্পর্কে শুনলে:

রাম ! রাম ! রাম !

অথবা, ওঁ বিষ্ণু, ওঁ বিষ্ণু, ওঁ বিষ্ণু


প্রবাসে যাওয়ার সময়:

ওঁ ত্রিবিক্রম ! (তিন বার)


রোগে আক্রান্ত হলে:

ওঁ প্রসীদ পরমানন্দ প্রসীদ পরমেশ্বর।

আধি-ব্যাধি ভূজাঙ্গনে দষ্টং মামুদ্ধর প্রভো।।


যুদ্ধকালে:

ওঁ চক্রধর! (তিন বার)


বনপথে গমনকালে:

ওঁ নৃসিংহদেব ! (তিন বার)


অগ্নিভয়ে:

ওঁ জকলাশায়িনম্ ! (তিন বার)


বিবাহকালে:

ওঁ প্রজাপতে ! (তিন বার)


পর্বত আরোহনকালে:

ওঁ রঘুনন্দনম ! (তিন বার)


কোন ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎকালে:

দুই হাত জোড় করে বুকের কাছে হাত নিয়ে এসে "নমস্কার"।

তারপরে,

নমস্তে অস্তু আয়তে নমো অস্তু পরায়তে।

নমস্তে রুদ্র তিষ্ঠত আসীনায়োততে নমঃ।। 

(অথর্ববেদ ১১.২.১৫)


সর্বকার্যে: হরে কৃষ্ণ

অথবা, ওঁ মাধব! (তিন বার)


জলপান করার সময়:

ওঁ ইদমাপঃ প্রবহত য়ৎ কিষ্ণ দুরিতং ময়ি।

য়দ্বাহমভিদুদ্রোহ য়দ্বাশেপ উতান্তম্।।

(ঋগ্বেদ ১.২৩.২২)

তথ্য সংগ্রহঃ উইকিপিডিয়া

Post a Comment

0 Comments